রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪৮ পূর্বাহ্ন
আবুল হাসান আবদুল্লাহ:
হজের ফজিলত সংক্রান্ত এ হাদিসখানা সবারই জানা, ‘যে হজ করে এবং (তাতে সবধরনের) অশ্লীল কথা ও কাজ এবং গোনাহ-পাপাচার থেকে বিরত থাকে সে সদ্যজাত শিশুর মতো (নিষ্পাপ) হয়ে যায়।’ -সহিহ বোখারি: ১৫২১
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এই ক্ষমা ও মাগফেরাতের দাবি হচ্ছে, বান্দার তরফ থেকেও পাপমুক্ত জীবন যাপনে সচেষ্ট হওয়া। এটা এই মহাপুরস্কারের প্রকৃত মূল্যায়ন।
পাপমুক্ত জীবন মানে কী? প্রসঙ্গটি বেশ বিস্তৃত। এর জন্য বুঝতে হবে পাপ মানে কী। সহজ ভাষায় ইসলামের অবশ্য পালনীয় বিধিবিধান লঙ্ঘন করাই পাপ। তাহলে ইসলামের বিধিবিধানের পরিধি যত বড় পাপ-পুণ্যের ক্ষেত্রও তত বিস্তৃত। ইসলাম তো অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদের মতো নিছক আচার ও আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব কোনো ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে মানবজীবনের সবক্ষেত্রের জন্য আলোকবর্তিকা, যে ক্ষেত্রগুলোর প্রধান প্রধান শিরোনাম এই ‘আকাইদ’ (বিশ্বাস), ‘ইবাদাত’ (উপাসনা), ‘মুআমালা’ (লেনদেন), ‘মুআশারা’ (সমষ্টিগত জীবনের নীতি ও বিধান) ও ‘আখলাক’ (স্বভাব-চরিত্র) ইত্যাদি।
এই সবগুলো ক্ষেত্রেই রয়েছে আল্লাহর বিধান ও নবী কারিম (সা.)-এর সুন্নাহ। এরই নাম দ্বীন ও শরিয়ত। এরই অনুসরণ পুণ্য আর অন্যথা পাপ। সুতরাং পুণ্যময় পাপমুক্ত জীবনযাপনের অর্থ জীবনের সবক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ও আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহর অনুসরণ। যারা আল্লাহর ঘর স্বচক্ষে দর্শন করেছেন এবং তাওয়াফের সৌভাগ্য লাভ করেছেন, যারা আল্লাহর রাসুলের রওজায় সশরীরে উপস্থিত হয়েছেন এবং দরুদ ও সালাম পেশ করেছেন তাদের তো নিশ্চয়ই এই প্রেরণা জাগ্রত হয়েছে যে, আগামী জীবন ইনশাআল্লাহ আল্লাহর বিধান মোতাবেক ও রাসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী অতিবাহিত করব। এই পবিত্র প্রেরণার সঙ্গে যখন যুক্ত হবে সৎসাহস আর যাত্রা আরম্ভ হবে নতুন জীবনের নতুন পথে, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যও হতে থাকবে।
কাবার মালিকের প্রতিশ্রুতি, ‘যারা আমার (সন্তুষ্টির) পথে চেষ্টা করবে আমি অবশ্যই তাদের আমার (সন্তুষ্টির) পথে পরিচালিত করব। সুতরাং হজ পরবর্তী নতুন জীবনে আমাদের কাজগুলো হবে এমন-
এক. আকিদা বিশ্বাসের সংশোধন। ইতিপূর্বে শয়তানের ধোঁকায় কোনো প্রকারের শিরকি-বিদআতি কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে তা থেকে দূরে থাকার পূর্ণ ইরাদা করা এবং হাক্কানি আলেমদের সাহচর্যের মাধ্যমে শিরক-বিদআত সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা। সবধরনের কুফরি ও বেদ্বীনি চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ড থেকে আত্মরক্ষার জন্য এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা।
দুই. ইবাদত-বন্দেগির দুরস্তি। ইসলামের ফরজ ইবাদতগুলো, যেমন দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সময়মতো আদায় করা, সম্পদের জাকাত দেওয়া, রমজান মাসের রোজা রাখা, ফরজ হজ আদায় করা (এটা তো আল্লাহর রহমতে আদায় করা হয়েছে) ইত্যাদি বিষয়ে খুব যতœবান হতে হবে। সুন্নতে মোয়াক্কাদার গুরুত্ব দিতে হবে। সাধ্যমতো নফল আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। এর পাশাপাশি নিয়মিত কিছু পরিমাণে হলেও কোরআন তেলাওয়াত, বিভিন্ন সময়ের মাসনুন দোয়া, কিছু পরিমাণে আল্লাহর জিকির ও ইস্তিগফার ইত্যাদি ইবাদতে মনোযোগী হলে ইনশাআল্লাহ অনেক খাইর ও বরকতের কারণ হবে।
তিন. লেনদেনে হারাম উপার্জন ত্যাগ করা এবং অন্যের পাওনা পরিশোধ করা অতি জরুরি। মনে রাখতে হবে, লেনদেনে হারাম ছাড়তে না পারলে দ্বীনদার হওয়া যায় না। সুদ, ঘুষ, ও অন্যান্য হারাম থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করতে হবে এবং হালাল উপায়ে যতটুকু উপার্জন হয় তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
চার. সমষ্টিগত জীবনের নীতি ও বিধান জেনে তা অনুসরণের চেষ্টাও জরুরি। এর সারকথা হলো- প্রত্যেকের হক সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা আদায় করা। পিতা-মাতার হক, আত্মীয়-স্বজনের হক, পাড়া-প্রতিবেশীর হক, সহকর্মী ও দায়িত্বশীলের হক, সাধারণ মুসলমানের হক, এমনকি অমুসলিম ও পশু-পাখির হকও ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান অর্জন করে সে অনুযায়ী নিজের কর্ম ও জীবন পরিচালিত করতে হবে।
পাঁচ. আখলাক তথা স্বভাব-চরিত্রের দুরস্তি। এটা ইসলামের অনেক বড় অধ্যায় এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। স্বভাবের ভালো প্রেরণা ও বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন বিনয়, নম্রতা, ক্ষমাশীলতা, উদারতা, সংযম, পরোপকার, অন্যের হিত কামনা ইত্যাদি জাগ্রত ও কার্যকর করা এবং স্বভাবের মন্দ প্রবণতাগুলো যেমন অহংকার, ক্রোধ, কৃপণতা, অসংযম, অন্যের অনিষ্ট কামনা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা একজন ভালো মানুষ হওয়ার বিকল্পহীন বিষয়।
আর এ তো স্বীকৃত কথা যে, একজন ভালো মুসলমান নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। মানুষের স্বভাব-চরিত্র যেহেতু তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই আচার-ব্যবহার সুন্দর হওয়ার জন্য স্বভাব-চরিত্র ভালো হওয়া জরুরি। একজন সাধারণ মানুষের অসৎ আচরণের চেয়ে একজন মুসল্লি বা একজন হাজি সাহেবের অসৎ আচরণ অধিক দৃষ্টিকটু। এ কারণে তাদের আচার-ব্যবহার সুন্দর ও শালীন হওয়া অধিক কাম্য।
তো জীবনের এই যে ধারা পরিবর্তন, তা কারও কারও কাছে অতি কঠিন, এমনকি অসম্ভবও মনে হতে পারে। বাস্তবেও তা অনেকের জন্য কঠিন তবে সংকল্প ও সৎসাহসের সঙ্গে সঠিক উপায়ে অগ্রসর হলে তা অসম্ভব থাকে না। আল্লাহতায়ালা বান্দার জন্য তা সহজ করে দেন। সেই সঠিক উপায়ের একটি হচ্ছে, ‘সাহচর্য’। বেদ্বীন লোকদের সংশ্রব ত্যাগ করে দ্বীনদার ভালো মানুষের সাহচর্য অবলম্বন করলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়।
মানুষের কর্ম ও আচরণের ক্ষেত্রে পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা অনেক বড় প্রভাবক বিষয়। এ কারণে ইসলামে সৎসঙ্গের খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে, সঠিক সূত্র থেকে নির্ভুল জ্ঞান ও উপলব্ধি। দ্বীনের ওপর চলার জন্য দ্বীনি ইলমের কোনো বিকল্প নেই। তাই হাক্কানি আলেমদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনায় দ্বীনের অতিপ্রয়োজনীয় ইলম অর্জনের পাশাপাশি সঠিক দ্বীনি রুচি, নির্ভুল উপলব্ধি, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অর্জনও অতি প্রয়োজন। এই পথে যদি জীবন গড়ার মেহনত জারি রাখা যায় তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহতায়ালা এমন এক নির্মল, পবিত্র ও নতুন জীবনের সন্ধান দেবেন যার তুলনা পৃথিবীর কোনো সুখ-সম্পদের সঙ্গে হতে পারে না।
ভয়েস/আআ